মুসলমানদের সবচাইতে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফিতর। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে এই ঈদ অনুষ্ঠিত হয় বলে বিভিন্ন দেশে ঈদের উৎসব নিজেদের মতো করে হয়। তবে এটি কোথাও আগের দিন, কোথাও পরদিন অনুষ্ঠিত হয়। ফলে মুসলিম দেশগুলোতে দুই দিন পৃথকভাবে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। এক মাস রোজা শেষে এই ঈদ অনুষ্ঠিত হয় বলে ঈদযাপনের আগ্রহ ও প্রতীক্ষা থাকে বিশেষভাবে। যুগে যুগে এই উৎসবটি মুসলমানদের মধ্যে শুধু পারিবারিকভাবেই নয়, সামাজিকভাবেও উদযাপিত হয়ে এসেছে।
ঈদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা মসজিদ কিংবা ঈদগাহের আশপাশে বসবাসকারী মুসলমানদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়। ফলে ঈদের জামাতে পাড়া-প্রতিবেশী একসঙ্গে মিলিত হয়, নামাজ শেষে কোলাকুলি বা কুশল বিনিময় করে থাকে। অনেক জায়গায় ঈদের জামাত বেশ বড় আকারে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সেখানে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ নামাজে অংশগ্রহণ করেন। এই ঈদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সকলেই নতুন পোশাক, জুতা-স্যান্ডেল পরার চেষ্টা করেন। সে কারণে ঈদের জামাতের দৃশ্যটি বেশ নতুন পোশাকে সজ্জিত মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। ছোট-বড় সকলেই নতুন সাজে ঈদ জামাতে অংশগ্রহণ করে। আরেকটি গুরত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শহরে যারা চাকরি, ব্যবসায়-বাণিজ্য বা অন্যান্য কাজকর্ম করেন, তারাও ঈদ উপলক্ষে গ্রামে যান। ফলে ঈদে গ্রামে যাওয়া সকলের সঙ্গেই ঈদ জামাতে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। কুশল বিনিময় এবং আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটানো হয়। ঈদ জামাত শেষে রান্না করা বিশেষ খাবার খাওয়ায় পরিবারের সদস্যরাই শুধু নয়, পাড়া-প্রতিবেশী এবং নিকট আত্মীয়স্বজনরাও এসে অংশ নেন। খাবার পরিবেশনায় শুধু নিজ ধর্মাবলম্বীরাই নয়, প্রতিবেশী, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বন্ধুবান্ধবরা সাদরে আমন্ত্রিত হন। ঈদের আনন্দ উপভোগে দলমত, গরিব-ধনী, ধর্ম ইত্যাদি পরিচয়ে কোনো বাধানিষেধ থাকে না। সেই হিসেবে ঈদুল ফিতর সবচাইতে বড় সামাজিক উৎসবেও পরিণত হয়েছে।
ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে বর্তমান যুগে দেশে দেশে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়তে দেখা যাচ্ছে। মূলত ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটায় পোশাক-পরিচ্ছদ, জুতা-স্যান্ডেল, গয়না এবং ঘরের নানা ধরনের সৌন্দর্যবর্ধক পণ্যসামগ্রী ব্যাপকভাবে কেনাবেচা হয়। মানুষের এসব চাহিদাকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের ফ্যাশন, ডিজাইনের পোশাক, কাপড়চোপড়, পণ্যসামগ্রীর পসরা সাজিয়ে অনেকেই শপিং মল, বিভিন্ন মার্কেট এবং ফুটপাতেও হকারদের বিক্রয়ের আয়োজন থাকে। ক্রেতাসাধারণ নিজেদের সামর্থ্য ও পছন্দ অনুযায়ী কেনাকেটা করে থাকেন। পোশাক ও জুতা-স্যান্ডেলের চাহিদা ও বেচাকেনা সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে।
পরিবারের শিশু সদস্যদের ঈদ মানেই হচ্ছে নতুন পোশাক, নতুন জুতা-স্যান্ডেল পাওয়া। সচ্ছল পরিবারে ঈদ উপলক্ষে উপহার দেয়ার, কেনাকাটা বেশ ঘটে। ঈদে নতুন নতুন পোশাক পাওয়ার তালিকায় শিশুদের কথা সবাই বিশেষভাবে গুরত্ব দেন। এ ছাড়া বয়স্কদেরও জামাকাপড়, শাড়ি পরিবারের সচ্ছল সদস্যরা দিয়ে থাকেন। সমাজের গরিব মানুষদের মধ্যে অনেকেই শাড়ি, লুঙ্গি জামাকাপড় বিতরণ করে থাকেন। ঈদ উপলক্ষে গৃহকর্মীদের সবাই নতুন কাপড়চোপড় প্রদান করেন। ফলে বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বিগত বছরগুলোতে বেশ বড় ধরনের কেনাবেচা, আর্থিক লেনদেন ঘটতে দেখা গেছে। এটি অর্থনীতির চাকা সচলে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে।
সমাজের সব ক্ষেত্রে রমজান এবং ঈদ উপলক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য, কেনাবেচা, অতিরিক্ত অর্থ বোনাস হিসেবে পাওয়া এবং খরচ করার মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরের মানুষ উৎসব-আনন্দ উপভোগ এবং নিজেদের মতো করে ছুটির কয়েকটি দিন আনন্দ উৎসবে কাটিয়ে দেন। এই ঈদ উপলক্ষে ‘নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার’ এবং পরিবারের সদস্য ও নিকটজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন। এই দৃশ্য আমরা অনেক আগে থেকেই দেখে আসছিলাম।
দেশ যত অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছিল, ঈদের উৎসবও ততটা সর্বজনীনতা লাভ করতে শুরু করছিল। প্রবাসে যারা কর্মরত আছেন, তারাও ঈদ উপলক্ষে পরিবারের সদস্যদের জন্য অর্থ প্রেরণ করেন। ফলে, ওইসব পরিবারও কেনাকাটা এবং উৎসব-আনন্দে নিকটজনদের নিয়ে ঈদের আনন্দ উপভোগ করে থাকে।
অর্থনীতি যখন ততটা সচ্ছল ছিল না, তখন ঈদ পালিত হতো, কিন্তু সবার ঘরে ঘরে নতুন জামাকাপড় কেনা বা উপহার হিসেবে পাওয়া যেত না। ঈদ জামাতের পরিবেশ ততটা চাকচিক্যময় ছিল না। মানুষ নামাজ শেষে ঘরে ফিরে মিষ্টিজাতীয় খাবার পরিবার এবং নিকটজনদের নিয়ে খেত। আনন্দ উপভোগটাও ছিল খুব সীমিত আকারে।
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন গ্রামে ঈদের আগ্রহ ছিল, কিন্তু কেনাকাটার সামর্থ্যটা বেশির ভাগ মানুষের ছিল না। পরিবারের সবার নতুন জামাকাপড় পরার অবস্থাও অনেকের ছিল না। তারপরও ঈদ্গাহে সবাই নামাজ শেষে কোলাকুলি ও কুশল বিনিময় করতে, শহর থেকে গ্রামে আসা প্রতিবেশীদের সঙ্গে গালগল্প করে সময় কাটানোর রেওয়াজ ছিল। আরেকটি বিষয় তখন প্রায়ই দেখা যেত, গ্রামে ঈদ উপলক্ষে নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধা, ফুটবল, ভলিবল খেলার আয়োজন করা হতো।
ঈদের পরদিন এসব আয়োজনে পাড়া-প্রতিবেশী বয়স নির্বিশেষে সকলেই আনন্দ উপভোগ করত। অনেক সময় এক গ্রামের সঙ্গে অন্য গ্রামের ফুটবল বা ভলিবলের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানও হতো। বর্ষাকালে নৌকাবাইচ বেশ উপভোগ্য ছিল। এই ধরনের পরিবেশ ঈদ উপলক্ষে কয়েক দশক আগে নিয়মিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম দিকে কিছুদিন অব্যহত থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈদ কিংবা ঈদ-পরবর্তী সামাজিক চিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। সমাজে অর্থবিত্তের ব্যাপক প্রসার ঘটছে, জৌলুসও বাড়ছে। কিন্তু সামাজিক ঐতিহ্যে পরিণত বিষয়গুলো উপেক্ষিত হচ্ছে, নানা ধরনের বাধানিষেধ, অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে সাংস্কৃতিকভাবে গ্রামীণ সমাজে ঐতিহ্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পশ্চাৎপদ পরিবর্তন ঘটেছে। ফলে এখন গ্রামে ঈদের আনন্দ বাহ্যিক সাজসজ্জা, নতুন পোশাক-আশাক, খাওয়াদাওয়া এবং পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।
গেল কয়েক বছর দেশে ঈদ অর্থনীতিতে একটি ধারণা চালু হয়েছে। ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে গোটা রমজান মাস দেশে নতুন পণ্যসামগ্রীর উৎপাদন, বাণিজ্যিকীকরণ, বিপণন ইত্যাদিতে প্রায় লাখ কোটি টাকার সঞ্চালন ঘটে থাকে। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে ঈদ অর্থনীতির প্রভাব বেশ গুরত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। উদ্যোক্তারাও রমজানকে কেন্দ্র করে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে থাকেন। অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান এই উপলক্ষে ঘটছিল।
গেল বছর আকস্মিকভাবে বৈশ্বিক করোনার সংক্রমণের কারণে আমাদের উদীয়মান অর্থনীতিতে বৈশাখী উৎসব এবং রমজান ও ঈদ উৎসবের সামগ্রিক আয়োজন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গেল বছর মানুষ রমজান ও ঈদে করোনা সংক্রমণের ভয়ে বের হতে পারেননি। গেলবারের ঈদ খুবই নিরানন্দের মধ্যে কাটে। ছন্দপতন ঘটে গ্রামে দলবেঁধে পাড়ি জমানোর। তারপরও নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কিছু মানুষ গেলবার গ্রামে ঈদ উদযাপন করতে গিয়েছিলেন। তবে এই উদযাপন আগের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার মতো ছিল না। শহরেও ঈদের অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধির নানা নিষেধাজ্ঞার কারণে তেমন একটা হতে পারেনি।
আশা করা গিয়েছিল ২০২১ সালের রমজানে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এত দীর্ঘস্থায়ী হবে সেটি অনেকেরই জানা ছিল না, বিশ্বাসেও ছিল না। তবে বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই বলে আসছিলেন যে করোনার সঙ্গে বিশ্বের মানুষকে আরও অনেক দিন বসবাস করতে হতে পারে। সেটিও অনেকের কাছে স্পষ্ট ছিল না।
বিশেষত এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে যখন সংক্রমণের হার নিম্নমুখী হতে থাকে, তখন অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে, করোনার সংক্রমণ শেষ হতে যাচ্ছে। কিন্তু মার্চে আবার সংক্রমণের গতি ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পর দেশে করোনার বিস্তার গেল বছরের চাইতেও বেশি অঞ্চলে ঘটতে দেখা যায়। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত করোনার আতঙ্ক নতুনভাবে ছড়িয়ে পড়ায় স্বাস্থ্যবিধি মানা, লকডাউন ইত্যাদি বিধিনিষেধ সরকার আরোপ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে জীবন-জীবিকার স্বাভাবিক গতি অনেকটাই কমে যায়। গেল এক বছরে নিম্ন আয়ের মানুষ কর্ম হারানোর মিছিলে যুক্ত হয়। বেসরকারি, ছোট ও মাঝারি নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। সেই সময়ে আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আমাদের ওপর আঘাত হানে। এবার করোনা সংক্রমণ ও উপসর্গের গতি-প্রকৃতি আগের বছরের চাইতে আগ্রাসী ছিল। অনেক মানুষ অক্সিজেনের অভাবে দ্রুত মৃত্যুবরণ করেন। হাসপাতালগুলোতে বেড, অক্সিজেন ও আইসিউ পাওয়া নিয়ে অনেকদিন বেশ সংকট ছিল।
সরকার দ্রুত উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেয়। তবে করোনা সংক্রমণের চেইন ভেঙে দেয়ার জন্য বেশ কিছু কড়াকড়ি নিয়ম আরোপ করায় করোনার ঊর্ধ্বগতি নিম্নমুখী হতে থাকে। কিন্তু এই সময়ে দুটি সংকট নতুন করে দেখা যায়। একটি হচ্ছে ভারতের নতুন ভ্যারিয়েন্ট আরও আগ্রাসী চরিত্র নিয়ে দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এটি নেপালেও ব্যাপক প্রাণহানি ঘটায়। বাংলাদেশে এই ভাইরাসের অনুপ্রবেশ ঘটার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেকারণে সরকার ও বিশেষজ্ঞমহল বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। দ্বিতীয় সমস্যাটি হচ্ছে টিকার মজুত শেষ হয়ে যাওয়া। ভারতের সেরাম কোম্পানি প্রতিশ্রুত টিকা দিতে পারছে না। অপরদিকে উন্নত দুনিয়া টিকা নিয়ে দর কষাকষি, প্রভাব বিস্তারের আলামত, টিকা হাতে রেখে বিভিন্ন দেশে করোনার সংক্রমণকে ছড়িয়ে দেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টিতে কার্যত বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক অবস্থা জোরদার করার লক্ষণ দেখা দিয়েছে।
ফলে আমাদের টিকা কর্মসূচি এখন অনেকটাই থমকে গেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের নতুন ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়লে চিকিৎসা-ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। একারণেই সরকার এ বছর সবাইকে যার যার অবস্থানে থেকে ঈদ করার আহ্বান জানিয়েছে। আগের মতো দলবেঁধে বাড়ি যাওয়ার পরিণতি বাংলাদেশে ভয়াবহ হতে পারে এমন আশঙ্কা বিশেষজ্ঞগণ বেশ কদিন থেকেই করে আসছেন। সেকারণেই সরকার আন্তজেলা পরিবহন, বাস-ট্রেন, লঞ্চ-স্টিমার বন্ধ রেখে মানুষকে সীমিত আকারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, কেনাকাটা করা এবং ঈদ উদযাপন করার আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু বিপণিবিতান সীমিত সময়ের জন্য খুলে দেয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার প্রবণতা সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। শহরাঞ্চলে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয়ার পর মানুষের চলাচল ও যাতায়ত যেভাবে বেড়েছে তাতে স্বাস্থ্যবিধি দারুণভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। বিরাটসংখ্যক মানুষ আন্তজেলা পরিবহন না থাকা সত্ত্বেও ছোট ছোট পরিবহন বা পায়ে হেটে গ্রামে ঈদ করবার জন্য শহর ছেড়েছেন। এমনকি পদ্মার ফেরি পারাপার নিয়েও যে দৃশ্যের অবতারণা ঘটেছে তা অভাবনীয়, অবর্ণনীয় এবং অকল্পনীয়ও বটে।
ঈদে বাড়ি যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মানুষের কতটা তীব্র সেটি এবারের ঈদযাত্রার দৃশ্য ও অভিজ্ঞতা দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষকেই সাধারণভাবে ঈদে যে পরিমাণ বাড়তি অর্থ খরচ করে বাড়ি যেতে দেখা যেত, তার চাইতেও বেশ কয়েকগুণ অর্থ খরচ করে তাদের এবার যেতে হয়েছে এবং সেটি তারা করছেনও। কিন্তু কোথাও স্বাস্থ্যবিধি নূন্যতম মেনে চলার তাগিদ নেই। যেকোনো মূল্যে বাড়ি যেতে হবে, পরিবার পরিজনদের সঙ্গে ঈদ করতে হবে, ঢাকায় থেকে একা একা তাদের কাছে ঈদ করা সম্ভব নয়।
ঈদযাত্রার এসব চিত্র দেখে যেটি বুঝতে হবে তা হলো ঢাকা বা বড় শহরে অনেকে জীবিকা নির্বাহের জন্য থাকলেও তাদের পরিবারের সদস্যরা আছেন বাড়িতেই। সুতরাং, ঈদে বাড়ি যাওয়ার মানসিকতা তাদের অনেক পুরোনো এবং প্রয়োজনীয়ও বটে। সেকারণে তারা মরিয়া হয়ে ঈদ যাত্রায় সকল বিড়ম্বনা ও অর্থদণ্ড মেনে নিচ্ছেন। আবার অনেকেই আছেন পরিবার-পরিজন নিয়েও এতসব বাধানিষেধ, অর্থদণ্ড উপেক্ষা করে গ্রামে ঈদ করতে যাচ্ছেন। এই সংখ্যাটিও কম নয়।
ছোট যানবাহনগুলো গত দেড় মাস পরিবহন সংকটের সুযোগ পেয়ে দারুণভাবে অর্থ কামাইয়ে নেমে পড়েছে। কোনো বাধানিষেধ ও জরিমানা তাদেরকে দূরপাল্লার যাত্রীবহনে থামাতে পারছে না। এবারের ঈদ যাত্রায় এমন দৃশ্য সচেতন মহলকে হতবাক করেছে। বিশেষজ্ঞগণ স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ এবং হতাশও বটে। তারা গণমাধ্যমের বিভিন্ন টক শোতে এসব দৃশ্য দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন যে, ঈদের পরে এই মানুষগুলো ফিরে আসার দুই সপ্তাহ পর মের শেষ এবং জুনের প্রথম সপ্তাহে দেশের গ্রামাঞ্চলেও করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। কেননা যারা দলবেঁধে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে গ্রামে এভাবে গিয়েছেন তাদের অনেকেই পথিমধ্যে করোনা সংক্রমিত হতে পারেন, বাড়ি গিয়ে তারা পরিবারের বয়স্কদের সংক্রমিত করতে পারেন। সেই সংক্রমণটি নীরবেই গ্রামের একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হতে পারে।
ঈদ শেষে আবার যখন তারা ফিরবেন তখন সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার সকল সম্ভাবনা থাকবে। এই অবস্থাটি আগামী দুই সপ্তাহ পরে ভিন্নরকম হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে পারবে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন চিকিৎসকরা।
সুতরাং, ঈদের আগে যেখানে আমরা মানুষকে পরিবার-পরিজনদেরকে নিয়ে আনন্দ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করার কথা বলতাম, লেখালেখি করতাম। এবার ঠিক বিপরীত কথাই লিখতে হচ্ছে, বলতে হচ্ছে। কিন্তু যত সংখ্যক মানুষই স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে ঈদ করতে বাড়ি গিয়েছেন তারা শেষ পর্যন্ত সুস্বাস্থ্য নিয়ে ফিরতে পারবেন কি না, ফিরলেও করোনায় আক্রান্ত হওয়া থেকে মুক্ত থাকবেন কি না সেটি- দেখার জন্য আমাদেরকে কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমরা কায়মানোবাক্যে প্রার্থনা করি তারা যেন নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছাতে পারেন, প্রিয়জনদের নিয়ে নির্বিঘ্নে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন, ঈদ শেষে ভালোভাবে কর্মস্থলে ফিরে আসতে পারেন এবং কোনোরকম করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত না হন। একই সঙ্গে আমাদের সকলেরই প্রার্থনা হোক, এবার ঈদের পর যেন নতুন করে ভয়ানক কোনো করোনার সংক্রমণকে দেখতে না হয়, ভারতের মতো অবস্থা সৃষ্টি না হয়।
লেখক: গবেষক, অধ্যাপক